সন্দেশখালির সাতকাহন পর্ব ২

বাবুরাই তো ভগবান। যে বাবু যত বেশি ভয় দেখাতে পারেন সেই বাবু তত বড় ভগবান। ভগবানের দয়াতে সরদারদের জীবন চলে। মুণ্ডা, বেদিয়া, ওরাঁও, ভূমিজ (ভুঁইয়া) প্রভৃতি পদবি ছেড়ে সুন্দরবনে ওরা প্রায় সবাই সরদার।

Mar 11, 2024 - 14:44
May 6, 2024 - 17:25
 0
সন্দেশখালির সাতকাহন পর্ব ২

রাধাবল্লভ রায়

সরদার পদবিটা আদিবাসীদের পাওয়া। সুন্দরবনের জঙ্গল কাটা এবং বাঁধ বাঁধার কাজে সরদারি করতে গিয়ে এই পদবি। দিয়েছিলেন সম্ভবত জমিদারের নায়েব-গোমস্তা বাবুরা। বাবুরাই তো ভগবান। যে বাবু যত বেশি ভয় দেখাতে পারেন সেই বাবু তত বড় ভগবান। ভগবানের দয়াতে সরদারদের জীবন চলে। মুণ্ডা, বেদিয়া, ওরাঁও, ভূমিজ (ভুঁইয়া) প্রভৃতি পদবি ছেড়ে সুন্দরবনে ওরা প্রায় সবাই সরদার। খুব সামান্য কিছু মানুষ সিং, নাইয়া এবং ভুঁইয়া। সরকারি খাতায় তা-ই লেখা। ইংরেজ রাজত্বে সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে চাষজমি বানানোর সময় ঠিকেদার-আড়কাঠিবাবুদের হাত ধরে লোনামাটিতে এসেছিল ওরা। আড়কাঠিবাবুদের নিয়োগ করতেন কলকাতার জমিদারবাবুরা। মানে মধ্যস্বত্বভোগীরা। মধ্যস্বত্ত্বভোগী আবার নানা রকমের। লটের মালিক লটদার। তার ভিতরে ভিতরে আরও অনেক মালিক। ব্যাপারটা বোঝার আছে। মেয়াদি লিজে সুন্দরবনের জঙ্গলজমি ইজারা নিয়ে লটদারবাবুরা ভাগে ভাগে বিক্রি করে দিতেন। যাঁরা কিনতেন স্থানভেদে তাঁদের বলা হত চকদার, গাঁতিদার, ঘেরিদার। তাঁরাই মধ্যস্বত্ত্বভোগী। তাঁরাই নিয়োগ করতেন আড়কাঠি ঠিকেদার। ময়ূরভঞ্জ থেকে নৌকা ক’রে, রাঁচি থেকে, পুরুলিয়া থেকে, বাঁকুড়া থেকে রেলের কামরা ভর্তি ক’রে মুন্ডা-ওঁরাওদের এনেছিলেন বাবুরা। জঙ্গলজমির লোভ দেখিয়েছিলেন। সেই লোভে কাজ হয়। স্বভূমিতে ১৮৫৫ সালের ক্ষোভ (সাঁওতাল বিদ্রোহ), ১৮৯৯ সালের (মুণ্ডা বিদ্রোহ) ক্ষোভ তখনও জেগেছিল ওদের। কিন্তু কিছু করার ছিল না। বাবুদের অনেক জোর। রেলপথ, কয়লাখনি, চা বাগান— সব জায়গায় কালো চামড়া এবং শক্ত বাহুর চাহিদা বাড়ে। বাজার। মানুষের বাজার। ছোটনাগপুরের জঙ্গল-জমির অধিকার হারিয়ে দিশাহারা মুণ্ডা-বেদিয়ারা সুন্দরবনে এসেছিল। আর গিয়েছিল উত্তরের চা বাগানে। শ্রম বিক্রি করে পেট চলত ওদের। জল-জঙ্গলের দেশে মানিয়ে নিতে গিয়ে অপঘাতে মরেছে কত যে তার ইয়ত্তা নেই। হিসেব রাখেনি কেউ।      

১৮২৮ সালে ডাম্পেয়ার-হজেস লাইন টেনে সুন্দরবনকে চব্বিশ পরগনা থেকে আলাদা করে ফেলে কোম্পানি সরকার। হজ সাহেবের সার্ভেতে ফাইনালি ২৩৬টি আবাদযোগ্য লট সুন্দরবন জুড়ে। এই বঙ্গের হুগলি নদী থেকে পূর্বদিকে পশর নদী পর্যন্ত। সেই লট কিনে ফেলেন কোম্পানির কর্মচারীরা এবং কলকাতার উঠতি বেনিয়াবাবুরা। লবণ, কাঠ, মাছ, ধান, চুন— ব্যবসা মন্দ চলেনি। ভবানীপুর, চেতলা, সুতানটিজুড়ে জমাটি বাজার। তারপর কোম্পানির বাবুরা অপারগ হন। শ্রমিকের অভাব এবং অভিজ্ঞতার অভাবে হটে যেতে হয়। কার্যকালও ফুরিয়ে যায় বাবুদের। ১৮৫৩ সাল থেকে আবার নতুন বন্দোবস্ত। এবারে লটের ক্রেতা সব কলকাতার ধনাঢ্য বাবুরা। উঠতিবাবু। সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, তিলি, ব্রাহ্মণ— এঁরাই হলেন সেই নতুন বাবু। ১৮৫৩ সালের বন্দোবস্ত আইনে বাবুরা ৯৭টি ইজারা সফল করে তোলেন। লটের পর লট বন কেটে গড়ে ওঠে আবাদি জমি। কলকাতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভাটিদেশের সুন্দরবনও ফাঁকা হতে থাকে। জঙ্গলজমি বন্দোবস্ত নেওয়ার হিড়িক তখন চারিদিকে। জমিদারির সামাজিক মর্যাদা এবং খেতাব পাওয়ার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে শুরু হয় পোর্ট ক্যানিং কোম্পানির উদ্যোগ। বন্দর গড়া চলে মাতলা নদীর তীরে। দুই বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সুন্দরবনের বিপুল সম্পদ রপ্তানি হবে এই বন্দরের পথে। ১৮৫৩ থেকে ১৮৬৩। জঙ্গলজমি কিনে বন-বাদা সাফ ক’রে রেল চালু হয়ে যায় শিয়ালদা থেকে মাতলা পর্যন্ত। বন্দর নির্মাণের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং মারা গেলেন ১৮৬২-তে। তাঁর স্মৃতিতে মাতলার নাম হয়ে গেল ক্যানিং। বন্দর হল, মিউনিসিপ্যালিটি হল, মাঝারি মাপের জাহাজ আসা যাওয়া করতে থাকল ক্যানিং বন্দরে। তারপর সুন্দরবনের বিপুল পরিমাণ ধানশস্য থেকে চাল উৎপাদনের জন্য এশিয়ার বৃহত্তম রাইসমিল গড়ে উঠল এখানে। কিন্তু অনেকটা এগিয়েও বন্দর এবং মিউনিসিপ্যালিটি টিকিয়ে রাখা গেল না। ১৮৬৪ সালের প্রবল ঝড়ের পর আবার ১৮৬৭ সালের ঝড়। সব ভেঙেচুরে তছনছ। এর মধ্যে বন্দর এবং মিউনিসিপ্যালিটি চালাত যে পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি তারাও পড়ে গেল লোকসানের মধ্যে। ফলে ১৮৭১ নাগাদ বন্ধ হয়ে গেল স-ব। তবে এদেশের ভূমিজ সম্পদকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করায় বিরত হয়নি ঔপনিবেশিক সরকার। এবার পোর্ট ক্যানিং কোম্পানিকে লটের ব্যবসায় নামিয়ে দিল তারা। লাটকে লাট জমি বন্দোবস্ত নিয়ে সরকারের পক্ষে কোম্পানি স্বয়ং জমিদার। কোম্পানির নাম ‘দ্য পোর্ট ক্যানিং অ্যান্ড ল্যান্ড ইম্প্রুভমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড’। কম্পানির হেড অফিস বোম্বাইতে। কিন্তু কাজ চলে ক্যানিং-এর তিনটি রাজকীয় অফিস থেকে। পেল্লায় বিল্ডিং। তার সঙ্গে আবার দ্বীপে দ্বীপে কাছারিবাড়ি। ২৭টি কাছারি মোট। জমির পরিমাণ ৬,৬৮১ একর। এর মধ্যে লটের সংখ্যা ২৩-২৪টি। ছোট ছোট চকদার-ঘেরিদার কোম্পানির অধীনে নামে বেনামে হাজার-দেড় হাজার বিঘে জমি কিনে ভাগচাষি দিয়ে চাষ করাতে থাকে। আদিবাসী মুণ্ডা-বেদিয়া, মেদিনীপুরের ভাসা প্রজা এবং চব্বিশ পরগনার মুসলিম-পোদেরা সেই জমির ভাগচাষি। ১৯৪৭-৪৮-এ এই ভাগচাষিরা সংঘবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছিল জোতদার-ঘেরিদারদের বিরুদ্ধে। সন্দেশখালি-ক্যানিং-কাকদ্বীপ জুড়ে সেই লড়াইয়ের নাম তেভাগা আন্দোলন।

না, কাকদ্বীপে পোর্ট ক্যানিং কোম্পানির আধিপত্য ছিল না। সেখানে ছিল কাশিমবাজারের মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর লটদারি এবং সরকারের নিজস্ব খাস এলাকা। রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের নামে ফ্রেজারগঞ্জ এলাকায় ১৯১৯ থেকে মেদিনীপুরের ধনাঢ্য ঘেরিদাররা মালিকবাবু হয়ে পড়েন। মাইতি ঘেরি, সামন্ত ঘেরি, বেরার লাট, দিন্দা ঘেরি, হাজরা ঘেরি মালিকবাবুদের জমিদারি। সেই মালিকদের বিরুদ্ধে তেভাগার দাবিতে আন্দোলন করে মেদিনীপুর থেকে আগত ভূমিহীন ভাসা প্রজারা। ১৯৪৬-৪৮ জুড়ে তুমুল লড়াই। সেই লড়াই ছড়িয়েছিল ক্যানিং-সন্দেশখালিতেও। পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি ছিল ক্যানিং-সন্দেশখালি-হাড়োয়ার জমিদার। সুবিস্তৃত জমিদারি। কিন্তু জমিদারির মধ্যেও ছিল আরও অনেক জমিদারি। ঔপনিবেশিকদের কায়দা। রায়তওয়ারি ভিত্তিক খাস সম্পত্তি কিনে বড় কৃষকরাও জমিদার হয়ে ওঠে। কাগজে-কলমে রায়ত। কিন্তু মেজাজে সবাই জমিদারদেরও এককাঠি উপরে। সেই খাস এলাকা ছিল বর্তমান বাসন্তীর গোলাবাড়ি-চুনোখালি-বড়িয়া হয়ে সরবেড়িয়া, হাড়োয়া, মিনাখাঁ এবং সন্দেশখালির বেড়মজুর-ঝুপখালি ছাড়িয়ে আরও। আদিবাসী, গরিব মুসলমান এবং মেদিনীপুর-ওড়িশার ভাসা প্রজারা এখানকার চাষিপ্রজা। কিন্তু চাষিপ্রজা হয়ে চিরকাল সক্কলে থাকতে পারেনি। ত্রিশ-চল্লিশের উথাল-পাথাল অর্থনীতির ধাক্কা আবাদি গাঁয়েও লাগে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪২-এর দুর্যোগ, ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ নিঃস্ব ভূমিহীন করে দেয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের। অন্যদিকে খাদ্যের জন্য মানুষের হাহাকার যত বাড়ে ততই বেড়ে চলে মজুতদারি এবং মহাজনি শোষণ। লাভ এবং লোভের তো কোনও সীমা থাকে না। কবি বলেছেন, ‘এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি--’। খাজনার সঙ্গে উপরি আদায় এবং ঋণের সুদ গুনতে গিয়ে চাষিপ্রজা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। ভাগচাষি হয়ে ক্লিন্ন কীটের মতো দীর্ণ জীবন তাঁদের। আনুগত্য দিতে দিতে মেরুদণ্ডটিও গুটিয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শেষে কোনও এক অদৃশ্য বলে ওরা ভাঙা মেরুদণ্ডে শক্তিসঞ্চয় করে। রুখে দাঁড়ায়। ফ্লাউড কমিশনের ঘোষণার পর সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রভাস রায়, হেমন্ত ঘোষালদের মতো শহুরে কমিউনিস্টবাবুরা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ওদের। তাঁদের শক্তিতে লড়াইয়ের ভিত গড়ে উঠেছিল। (চলবে)

[পড়ুন অন্যান্য পর্বগুলি...]

সন্দেশখালির সাতকাহন পর্ব ১

সন্দেশখালির সাতকাহন পর্ব ৩

সন্দেশখালির সাতকাহন পর্ব ৪

সন্দেশখালির সাতকাহন পর্ব ৫

সন্দেশখালির সাতকাহন পর্ব ৬

সন্দেশখালির সাতকাহন পর্ব ৭

সন্দেশখালির সাতকাহন পর্ব ৮

সন্দেশখালির সাতকাহন পর্ব ৯

সন্দেশখালির সাতকাহন পর্ব ১০